লাইকেন – শৈবাল ও ছত্রাকের সহাবস্থানঃ
উদ্ভিদজগতে এরা পৃথক রাজ্যের বাসিন্দা হলেও প্রকৃতিতে শৈবাল ও ছত্রাককে একই সাথে সিমবায়োটিক সহাবস্থানে দেখা যায়। শৈবাল ও ছত্রাক মিলিতভাবে সম্পূর্ণ পৃথক ধরনের একজাতীয় উদ্ভিদের সৃষ্টি করে যাকে বলা হয় লাইকেন। লাইকেন হলো শৈবালতুল্য ছত্রাক বিশেষ। লাইকেন স্বয়ংসম্পূর্ণ, বিষমপৃষ্ঠ, থ্যালয়েড, অপুষ্পক উদ্ভিদ। সারা পৃথিবীতে প্রায় ৪০০টি গণ এবং ১৭,০০০ লাইকেন প্রজাতির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। দুটি ভিন্ন প্রজাতির জীবের মধ্যে যখন এমন সম্পর্ক স্থাপিত হয় যে তাদের ঘনিষ্ঠভাবে সহাবস্থানের ফলে একে অন্যের নিকট হতে উপকৃত হয় তখন তাদের এ ধরনের সম্পর্ককে মিথোজীবিতা (symbiosis) বলে।
লাইকেনের বাসস্থানঃ
লাইকেন এমন একটি সম্প্রদায় যারা এমন সব পরিবেশে জন্মাতে পারে, যেখানে অন্য আর কোনো জীব বেঁচে থাকতে পারে না। যেমন- অনুর্বর, বন্ধ্যা, বালু বা পাথরের মতো আবাসে এরা স্বাচ্ছন্দ্যে জন্মাতে পারে। এরা গাছের বাকল, সজীব পাতা, বন্ধ্যা মাটি, পাকা দেয়াল, ক্ষয়প্রাপ্ত কাঠের গুড়ি ইত্যাদি বস্তুর উপর জন্মে থাকে। তুন্দ্রা অঞ্চল, মরু অঞ্চল, নীরস পর্বতগাত্রসহ সমস্ত প্রতিকূল অবস্থানে এরা জন্মাতে পারে। তাই লাইকেনকে বিশ্বজনীন উদ্ভিদ বলা হয়।
লাইকেনের বৈশিষ্ট্যঃ
লাইকেন একটি দ্বৈত সংগঠন। কারণ একটি শৈবাল ও একটি ছত্রাক সদস্য মিলিতভাব এ সংগঠন তৈরি করে।
*ছত্রাক থ্যালাসের কাঠামো তৈরি করে এবং কাঠামোর ভেতরে শৈবাল আবৃত অবস্থায় থাকে। শৈবাল থ্যালাস এর ৫-১০% ভর বহন করে।
*আকৃতিগতভাবে লাইকেন থ্যালয়েড, চ্যাপ্টা, বিষমপৃষ্ঠ অথবা শাখা-প্রশাখা যুক্ত হয়।
*এরা অধিকাংশই ধূসর বর্ণের তবে সাদা, কালো, কমলা, হলুদ ইত্যাদি বর্ণের হয়ে থাকে।
*লাইকেনের উভয় জীবে অঙ্গজ ও অযৌন জনন ঘটে। কিন্তু যৌন জনন শুধুমাত্র ছত্রাক সদস্যের ঘটে।
লাইকেন অনুর্বর বন্ধ্যা মাধ্যমেও জন্মে, যেখানে অন্য কোন জীব সম্প্রদায় জন্মাতে পারে না।
*থ্যালাসের নিচের দিকে রাইজয়েডের মতো রাইজাইন থাকে, যা দিয়ে পানি শোষণ করে।
*এরা স্বভোজী তাই স্বয়ংসম্পূর্ণ।
*কঠিন শিলাতেও মাটি গঠনে এরা অগ্রদূত হিসেবে ভূমিকা পালন করে।
*এরা বায়ুদূষণের প্রতি উচ্চমাত্রায় সংবেদনশীল।
লাইকেনের গঠন এবং ছত্রাক ও শৈবালের পারস্পরিক নির্ভরশীলতাঃ
ক.লাইকেন এর বাহ্যিক গঠনঃ
লাইকেন সমাঙ্গদেহী, এদের অধিকাংশই ধূসর বর্ণের; তবে সাদা, কমলা-হলুদ, সবুজ, পীতাভ-সবুজ অথবা কালো ইত্যাদি বর্ণের। এরা অত্যন্ত ক্ষুদ্রাকার হতে কয়েক ফুট পর্যন্ত দীর্ঘ হতে পারে। একটি লাইকেন দুটি জীবীয় উপাদান নিয়ে গঠিত। একটি শৈবাল যাকে ফটোবায়োন্ট (photobiont) বলে। এরা নীলাভ-সবুজ শৈবাল বা সবুজ শৈবালের অন্তর্ভুক্ত। অপরটি ছত্রাক যাকে মাইকোবায়োন্ট (mycobiont) বলে। এরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অ্যাসকোমাইসিটিস শ্রেণির এবং কিছু কিছু ব্যাসিডিওমাইসিটিস শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। লাইকেনে শৈবাল ও ছত্রাক উভয়ই উপকৃত হয় এবং কেউ কারও অপকার করে। এরূপ উপকার ভিত্তিক সম্পর্ককে মিথোজীবিতা বা অন্যোন্যজীবিতা (symbiosis) বা মিউচুয়ালিজম (mutualism) বলে।
খ.লাইকেনের অন্তর্গঠনঃ
লাইকেনকে প্রস্থচ্ছেদ করলে একাধিক গঠনগত স্তর দৃষ্টি গোচর হয়। একটি ফোলিয়োজ লাইকেনের অন্তর্গঠন নিম্নরূপ:
•উর্ধ্ব কর্টেক্সঃ ঘন সন্নিবেশিত ছত্রাকীয় হাইফি দ্বারা এই স্তর গঠিত। এ স্তরে সাধারণত ফাক থাকে না, থাকলেও মিউসিলেজ দ্বারা পূর্ণ থাকে।
•শৈবাল স্তরঃ এই স্তরে ছত্রাকের হাইফির ফাঁকে ফাঁকে শৈবাল অবস্থিত। এই স্তরটি সংক্ষিপ্ত। একটি নির্দিষ্ট প্রজাতির লাইকেনে শুধু এক ধরনের শৈবালই থাকে। পূর্বে এ স্তরকে গনিডিয়াল স্তর বলা হতো। কতকগুলো প্রজাতিতে ছত্রাকের হাইফি। হতে শৈবালের কোষে হস্টোরিয়া প্রবেশ করে।
•নিম্ন কর্টেক্সঃ মেডুলার নিচে ঘন সন্নিবেশিত ছত্রাকীয় হাইফি দ্বারা এই স্তর গঠিত। এই স্তরের নিম পৃষ্ঠে বহু এককোষী রাইজাইন (রাইজয়েড তুল্য) থাকে যা লাইকেনকে নির্ভরশীল বস্তুর (বৃক্ষের বাকল, পাথর ইত্যাদি) সাথে আটকিয়ে রাখে এবং খাদ্যরস শোষণ করতে রাইজাইন সাহায্য করে। রাইজাইন হলো দেহের নিমাংশে চুলের ন্যায় একটি অঙ্গ, যা । মূলের মতো কাজ করে থাকে।
•মেডুলাঃ অত্যন্ত ফাকা ফাঁকাভাবে অবস্থিত ছত্রাকীয় হাইফি দ্বারা এই স্তর গঠিত। এই স্তর অপেক্ষাকৃত পুরু। হাইফি থ্যালাসের প্রান্তের দিকে বেশ পাতলা কিন্তু কেন্দ্রীয় অঞ্চলে ঘনভাবে সন্নিবিষ্ট। শৈবাল স্তরের নিচে এটি অবস্থিত। এ অঞ্চলের হাইফির শাখা-প্রশাখা বিভিন্ন দিকে বিস্তৃত।
লাইকেনে শৈবাল যেভাবে উপকৃত হয়ঃ
ছত্রাক নিজ দেহে আশ্রয়দানের বিনিময়ে শৈবাল কর্তৃক উৎপাদিত খাদ্য হস্টোরিয়ামের সাহায্যে গ্রহণ করে বেঁচে থাকে অর্থাৎ শৈবালের প্রস্তুতকৃত খাদ্য উভয়েই ভাগ করে গ্রহণ করে। ছত্রাকের শারীরবৃত্তীয় কাজের ফলে সৃষ্ট বর্জ্য ও জলীয়বাষ্প দেহ থেকে অপসারণের জন্য ছত্রাককে কোনো ধরনের শক্তির অপচয় করতে হয় না। লাইকেনে ছত্রাকের চেয়ে শৈবালের গুরুত্ব অনেক বেশি। কারণ লাইকেনে ছত্রাক সদস্য এককভাবে বেঁচে থাকতে পারে না। কিন্তু শৈবাল সদস্য এককভাবে বেঁচে থাকতে পারে। লাইকেনে শৈবালের চেয়ে ছত্রাক বেশি সুবিধা ভোগ করে এবং অন্যদিকে শৈবালটি ছত্রাকের কৃতদাস হিসেবে অবস্থান করে বলে কোনো কোনো উদ্ভিদবিজ্ঞানী এরূপ সহাবস্থানকে বিশেষ ধরনের মিথোজীবিতা বা হেলেটিজম (helotism) বলে আখ্যায়িত করেছেন।
অধিকাংশ লাইকেনের ক্ষেত্রে ছত্রাক সদস্যটি শৈবাল কোষের অভ্যন্তরে হস্টোরিয়া নামক শোষক অণুসূত্র প্রেরণ করে পুষ্টি সংগ্রহ করে বলে এরূপ সহাবস্থানকে আংশিক পরজীবিতা বলে উল্লেখ করেছেন।
লাইকেনের জননঃ
লাইকেন অঙ্গজ, অযৌন এবং যৌন উপায়ে বংশবৃদ্ধি করে থাকে। থ্যালাসের খণ্ডায়ন (fragmentation) ও ক্রমাগত মৃত্যু ও পচন (progressive death & decay) প্রক্রিয়ায় লাইকেনের অঙ্গজ জনন ঘটে থাকে। সোরেডিয়া (Soredia, একবচনে-Soredium) ও ইসিডিয়া (Isidia, একবচনে- Isidium) এর পিকনিডিওস্পোরের মাধ্যমে। অযৌন জনন হয়ে থাকে। সোরেডিয়াম হলো একটি শৈবালকে ছত্রাক দ্বারা চারদিক থেকে ঘিরে থাকা ক্ষুদ্রাকার দেহ যা বাতাসে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং উপযুক্ত পরিবেশে লাইকেন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
ইসিডিয়াম হলো লাইকেনের উধ্ব কর্টেক্স দ্বারা আবৃত, ক্ষুদ্রাকার, সরল বা শাখান্বিত প্যাপিলির ন্যায় অযৌন রেণু যা বদ্ধিপ্রাপ্ত ও রূপান্তরিত হয়ে লাইকেন গঠন করে। পিকনিডিয়া (Pycnidia) হলো ফ্লাস্কের ন্যায় গঠনযুক্ত অংশ যারা মূলত লাইকেনের কিছু ছত্রাক দেহে (যেমন- Cladonia sp.) গঠিত হয়। পিকনিডিয়ার অভ্যন্তরে পিকনিডিওস্পোর গঠিত হয়। পিকনিডিওস্পোর অঙ্কুরোদগমের মাধ্যমে নতুন ছত্রাক অণুসূত্র গঠন করে। নতুন গঠিত ছত্রাক অণুসূত্র উপযুক্ত পরিবেশে শৈবালের সংস্পর্শে এলে নতুন লাইকেন গঠন করে।
লাইকেনে যৌন জনন মূলত ছত্রাক দ্বারা সীমাবদ্ধ থাকে। অ্যাস্কোলাইকেনে যৌন জনন সম্পাদিত হয় অ্যাস্কোকার্প (ascocarp) দিয়ে। এছাড়া প্লাজমোগ্যামির মাধ্যমেও লাইকেনের যৌন জনন সম্পন্ন হয়ে থাকে। প্লাজমোগ্যামি হলো, যে প্রক্রিয়ায় যৌন মিলনের পর ছত্রাকের দুটি জনন কোষের প্রোটোপ্লাজম মিলিত হয় কিন্তু নিউক্লিয়াস দুটি মিলিত হয় না। লাইকেনের পুংজননাঙ্গকে স্পার্মাগোনিয়াম এবং স্ত্রীজননাঙ্গকে কার্পোগোনিয়া বলে।